Wednesday, March 3, 2021

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

 বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’—সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনি পালামৌ থেকে নেওয়া সর্বজনে জানা উদ্ধৃতি। এবারের বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য যেন পালামৌর এই উদ্ধৃতিটি মনে করিয়ে দেয়। প্রতিপাদ্যটি হলো ‘বন ও জীবিকা: মানুষ ও গ্রহকে বাঁচাই’।

২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আজ বুধবার বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে। তবে মূল কথা হলো, মানুষকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জানা দরকার, বাংলাদেশের বন ও বন্য প্রাণীদের অবস্থা কী?

বাংলাদেশে বৈশ্বিক পরিস্থিতির তুলনায় জীববৈচিত্র্য হ্রাসের হার বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশে উজাড় হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বিশ্বে ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে দুই তৃতীয়াংশ। ৫০ বছরে স্থলভূমির তিন-চতুর্থাংশ এবং সমুদ্রের ৪০ শতাংশ প্রাণ-বৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০০ বছরে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী।

পরিবেশবিধ্বংসী ‘উন্নয়নমূলক’ কাজ এবং প্রকৃতির পরিবর্তনের প্রভাব বন্য প্রাণীর ওপর পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, বাঁধ, রাস্তা, জলাভূমি দখল এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাচ্ছে; ধ্বংস হচ্ছে প্রাণীদের আবাসস্থল। সংরক্ষিত এলাকায়ও বন্য প্রাণীরা নিরাপদ থাকতে পারছে না। বন বিভাগের হিসাবে, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গাড়ির চাপায় প্রতিবছর গড়ে ৫০টি প্রাণী মারা যায়।

এদিকে চট্টগ্রামে হাতির চলাচল পথে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। লোহাগড়ার চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে রেললাইন নির্মাণের কারণে বন্য হাতির চলাচল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বন্য প্রাণীর জন্য সুন্দর আবাসস্থলগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) সবুজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। বিশ্বের ১৫টি দেশের ৪৯টি অঞ্চল এ পর্যন্ত ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল এখনো সবুজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

আন্তর্জাতিকভাবে বন্য প্রাণী পাচারে বাংলাদেশ ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পত্রিকান্তরে জানা যায়, সড়ক, নৌ ও আকাশপথে প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ পাচার হয়। পাচারের কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বনরুই ও তক্ষক—এ তিনটি প্রাণী বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বন বিভাগ, পুলিশ, র‍্যাব, কোস্টগার্ড, কাস্টমস ও বিজিবির সমন্বয়ে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট গঠন হলেও পাচার ও নিধন বন্ধ হয়নি। অথচ দেশে বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে ১৯৭৩ সালের আইনকে সংশোধন করে ‘বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। যদিও আইনের তোয়াক্কা না করে সংরক্ষিত এলাকায় উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশে ৪১টি এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। ২২টি সংরক্ষিত এলাকায় স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সহযোগী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি শকুন রক্ষায় কিটোপ্রোফেন ওষুধ উৎপাদন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং আইইউসিএনের মতো বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঘ, ঘড়িয়াল, ডলফিন, শকুন ইত্যাদি কিছু প্রজাতি সংরক্ষণে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। সম্মিলিত উদ্যোগ আরও নেওয়া গেলে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুধাবন করেছিলেন—যার জায়গা যেখানে তাকে সেখানেই থাকতে দিতে হবে। মানবশিশুর সুষ্ঠু বিকাশে মাতৃকোলের গুরুত্ব যেমন, বন্য প্রাণীদের বিকাশ এবং ভালো থাকার জন্যও চাই সুন্দর ও নিরাপদ বন। স্বাধীন রাষ্ট্র ও নির্বাহী বিভাগ এ সত্য অনুধাবন করে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলেই বন্যেরা বনে এবং শিশুরা মায়ের কোলে নিরাপদ থাকবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশে আইইউসিএন জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন।


rt@du.ac.bd


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: